দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হারের প্রবল উঠানামার কারণে ব্যাংকের তহবিল বা তারল্য ব্যবস্থাপনার মধ্যে কোনো ধরনের ব্যর্থতা দেখা দিলে এর দায় পরিচালনা পর্ষদকে নিতে হবে। ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনার আওতায় পরিচালিত সব ধরনের কর্মকাণ্ডের নীতিমালা প্রণয়ন ও তদারকির দায়িত্ব এখন থেকে পর্ষদের ওপর ন্যস্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব কর্মকাণ্ড ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে যারা সম্পাদন করবেন তাদেরও নির্বাচন করবে পর্ষদ। তাদের কাছ থেকে জবাবহিদিতাও আদায়ের দায়িত্ব এখন পর্ষদের।
 
 
‘সুদের হারের ঝুঁকির বিষয়ে ব্যাংকিং বই’ শীর্ষক একটি নতুন নীতিমালায় পর্ষদকে এসব ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আগে এসব ক্ষমতা ছিল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের হাতে। শরিয়াভিত্তিতে পরিচালিত ব্যাংকগুলোর জন্যও একই নীতিমালা প্রযোজ্য হবে। তরে এর নাম হবে ‘মুনাফার হারের ঝুঁকির বিষয়ে ব্যাংকিং বই’।
 
মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নীতিমালাটি সার্কুলার আকারে জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। সার্কুলারে আলোচ্য নীতিমালার নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংকগুলোকে তিন বছরের বেশি সময় দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৩০ জুনের মধ্যে দেশের সব ব্যাংককে এটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে এগুলো বাস্তবায়নের জন্য পরীক্ষামূলক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে ৩০ জুনের মধ্যে। এরপর থেকে প্রতি ছয় মাস পরপর অর্থাৎ অর্ধবার্ষিক ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন ও ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। এর মাধ্যমে আগামী তিন বছরে ব্যাংকগুলোকে নীতিমালাটি বাস্তবায়নে পুরোপুরি সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
 
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলো নানা ঝুঁকিতে রয়েছে। ঝুঁকি নিরসনে আগে সুশাসন নিশ্চিত ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। এ নীতিমালাটি ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে। তবে এটি সব ব্যাংকের ক্ষেত্রে সমানভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। কাউকে ছাড় দেয়া যাবে না।
 
তিনিও আরও বলেন, এটি অনেক কঠিন একটি নীতিমালা। এটি বাস্তবায়ন হলে ব্যাংকগুলোর গ্রহণযোগ্যতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাড়বে। ফলে আন্তর্জাতিক লেনদেন বা গ্যারান্টির ক্ষেত্রে সক্ষমতা বাড়বে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে খরচ কমবে।
 
নীতিমালায়, তারল্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ঋণ ও আমানতের সুদের হার নির্ধারণ, আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণের ব্যাপারে নীতিমালা প্রণয়ন এবং তদারকি করবে পর্ষদ। একই সঙ্গে গ্রাহকদের আমানতের অর্থ পরিশোধের বিষয়ে ৪ থেকে ৫ বছর মেয়াদি একটি কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র, স্থায়ী, তলবি ও বড় আমানতের পরিমাণ কেমন এবং কি মেয়াদে থাকতে হবে তার একটি হারও বেঁধে দেয়া হয়েছে।
 
এসব ঝুঁকি নিরূপণে প্রতিটি ব্যাংকে একটি করে ‘অ্যাসেট অ্যান্ড লিকুইডিটি ম্যানেজমেন্ট কমিটি (অ্যালকো)’ থাকবে। এ কমিটিতে কারা থাকবেন তা নির্ধারণ করবে পর্ষদ। পর্ষদ মনে করলে কমিটিতে পরিবর্তন আনতে পারবেন। নীতিমালার নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্বগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মূল উপাদানগুলো স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করে কাজের সুনির্দিষ্ট বিভাজনের মাধ্যমে দায়িত্ব বণ্টন করবে। এক্ষেত্রে যাতে কোনো ধরনের অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখবে পর্ষদ। ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের নিয়ে অ্যালকো গঠিত হবে। কমিটির কাজ তদারকি ও জবাবদিহিতা আদায় করবে পর্ষদ। প্রতি ছয় মাস পরপর তারল্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের প্রণীত নীতি পর্যালোচনা করে পরিবর্তন করবেন।
 
এতে আরও বলা হয়, অ্যালকো নিয়মতিভাবে ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে কথা বলে তাদের ঋণ ও আমানতের চাহিদা সম্পর্কে অবহিত হবে। এর ভিত্তিতে তারা তারল্য ব্যবস্থাপনা, ঋণ বিতরণের সক্ষমতা, আমানত সংগ্রহ ও পরিশোধের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। একই সঙ্গে নিরূপণ করবে সুদ হার উঠানামার কারণে সম্ভাব্য ঝুঁকি।
 
নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায় মৌলিক ভূমিকা পালন করবে অ্যালকো। ব্যাংকের সাংগঠিত কাঠামোর মধ্যে অ্যালকো যাতে তাদের দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয় এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে সে বিষয়ে পর্ষদ তাদের সব ধরনের সহায়তা করবে। একই সঙ্গে পর্ষদ ও অ্যালকোর সদস্যদের মধ্যে নিয়মিত বৈঠকের আয়োজনও করতে হবে। যাতে ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে পর্ষদ সব বিষয়ে অবহিত থাকতে পারে।
 
বেসরকারি ব্যাংকের একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ঝুঁকি নিরূপণে নীতিমালা সময়োপযোগী। কিন্তু এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন। বাস্তবায়নে তিন বছর পাওয়ায় ভালো হয়েছে।
 
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, পর্ষদের হস্তক্ষেপে অনেক সময় পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আমানত হিসাবে বেশি সুদ দেয়া বা ঋণ হিসাবে কম সুদ নেয়া হয়। এতে ব্যাংকের ক্ষতি হয়। নতুন নীতিমালার কারণে প্রতিটি ঋণ ও আমানত হিসাবের বিপরীতে ঝুঁকি নিরূপণ করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় পর্ষদের ক্ষমতা অনেক বাড়ানো হয়েছে। এখন এসব ক্ষেত্রে ঝুঁকির সৃষ্টি হলে পর্ষদকে জবাবদিহি করতে হবে।
 
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তারল্য ব্যবস্থাপনায় বড় দুর্বলতার ঘটনা প্রকাশ হয়েছে। তারা নিয়ম মেনে ঋণ ও আমানতের বিভাজন করেনি বলে এখন গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পুরো আর্থিক খাতের ওপর। একই সঙ্গে বিদেশেও দেশের আর্থিক খাতের সুনাম নষ্ট হচ্ছে।
 
নীতিমালায় বলা হয়, সুদের হারের কারণে তারল্য ব্যবস্থাপনায় সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। বেশি সুদে আমানত নিয়ে কম সুদে ঋণ বিতরণ করলে বা আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হারের উঠানামার কারণেও ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যাংকগুলোকে সুদের হারের দেশি-বিদেশি সব ধরনের ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে হবে।